হিমালয়ের কোলে পড়ে আছে একটি পা। জুতো আছে। মোজাও আছে। মোজার গায়ে সেলাই করা একটি নাম--AC IRVIN.
একশো বছর...!
ঠিক একশো বছরের নিঃসঙ্গতা নিয়ে পড়ে আছে পা-টি।
এই পা হয়তো প্রথম এভারেস্টের শিখর ছুঁয়েছিল।
ইতিহাস সব কিছু জানে না। জানার কথাও নয়।
বেচাকেনা চুকিয়ে, লেনাদেনা মিটিয়ে এসি স্যান্ডি আরভিন হিমালয়ে বিলীন হয়েছিলেন ১৯২৪ সালে।
কিন্তু তাঁর পা-টি এখনও পড়ে আছে। দেহের বাকি অংশ কোথায় ? কেউ জানে না। শুধু পা-টি আছে বরফের কোলে। পৃথিবীর সবচেয়ে আলোচিত রহস্যের সাক্ষী হয়ে।
কে এই এসি আরভিন ? একজন ব্রিটিশ পর্বত অভিযাত্রী।
তিনি এবং জর্জ ম্যালোরি একশো বছর আগে প্রথম এভারেস্টের চূড়ায় ওঠেন বলে জনশ্রুতি। কিন্তু স্রেফ প্রমাণের অভাবে তাঁরা সেই স্বীকৃতি পাননি। দুর্গম হিমালয়ে মিলিয়ে গিয়েছিলেন অকুতোভয় দুই প্রাণ। এন্ড্রু কোমিন 'স্যান্ডি' আরভিনের বয়স তখন ২২। ম্যালোরির ৩৭। কুয়াশায় ঘেরা, বরফ আচ্ছাদিত হিমালয়ে কোথায় হারিয়ে গেলেন তাঁরা ? আজও পৃথিবীর সেরা রহস্য সেটি।
কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক স্কুলশিক্ষক ম্যালোরি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ছিলেন ফ্রান্সে। যুদ্ধের পর দেশে ফেরার পরই পাহাড়ের নেশা চেপে বসে ম্যালোরির। বারবার ছুটে গিয়েছেন হিমালয়ের কোলে। তাঁকে প্রশ্ন করা হয়, 'বারবার হিমালয়ে যান কেন ?'
যে-উত্তরটি দিয়েছিলেন ম্যালোরি তা আজও সোনার অক্ষরে খোদাই করা আছে--কেন যাই ?
" বিকজ ইট ইজ দেয়ার। "
ম্যালোরির দেহ পাওয়া যায় ১৯৯৯ সালে। আমেরিকার এক অভিযাত্রী দল তাঁর দেহ খুঁজে পায়। ৭৫ বছর ধরে হিমালয়ে পড়ে আছে একটি দেহ। কোমরে দড়ির দাগ। শুধু কাছে নেই ম্যালোরির স্ত্রীর ছবিটি। প্রিয়তমার এই ছবিটি এভারেস্টের চূড়ায় রেখে আসার কথা ছিল। সন্দেহ আরও বাড়ে। তা হলে কি এভারেস্টের চূড়াতেই আছে স্ত্রীর ছবিটি ?
তেনজিং নোরগে এবং এডমন্ড হিলারি নন, এভারেস্টে প্রথম ওঠেন ম্যালোরি-আরভিন জুটি ?
সব রহস্যের কিনারা হয় না। এবং হয় না বলেই পৃথিবী এত সুন্দর।
আরভিনের পা খুঁজে পাওয়া যায় গত মাসে। এক পর্বত অভিযাত্রী ও সিনেমা নির্মাতার দলের নজরে আসে জুতো-মোজা পরা একটি পা পড়ে আছে। ম্যালোরির দেহাবশেষ যেখানে মিলেছিল তার বেশ খানিক নীচে শুয়ে আছে আরভিনের পা। ওই দলের সদস্য জিমি চিন বলেন, 'মোজাটা তুলে দেখি একটা লাল রঙের লেবেল। তাতে সেলাই করা আছে আরভিনের নাম।' দেহের বাকি অংশ নেই। নেই আরভিনের কোডাক ক্যামেরাটাও। এই ক্যামেরার হদিস পেলে হয়তো ইতিহাস অন্যরকম ভাবে লেখা হতো।
আরভিনের পায়ের খবর শুনে কেঁদে ফেলেন জুলি সামার্স। জুলি আরভিনের বংশধর এবং তাঁর জীবনীকারও বটে। তাঁর কথায়, 'আমি ছোটবেলা থেকে আমি হারিয়ে যাওয়ার কথা শুনে এসেছি। যেদিন ম্যালোরির দেহ মিলল, সেদিন ভেবেছিলাম আরভিনের দেহও নিশ্চয় পাওয়া যাবে।' ম্যালোরির দেহ উদ্ধারের ২৫ বছর পর মিলল আরভিনের পা। ঘটনাচক্রে সেই অভিযানের একশো বছর পরে। হয়তো আরও ২৫ বছর পর এভারেস্টের চূড়ায় কেউ খুঁজে পাবে এক নারীর ছবি। প্রচণ্ড তুষারঝড়েও যে-ছবিটি বরফের গায়ে লেগে আছে এক না-লেখা ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে। সেই নারীর নাম রুথ ম্যালোরি। জর্জ ম্যালোরির স্ত্রী।
কবি জানতেন, তাঁর পায়ের চিহ্ন একদিন পড়বে না এই বাটে। কিন্তু আরভিন কি জানতেন, তিনি নন, তাঁর পায়ের চিহ্নও নয়, তাঁর পা-টিই পড়ে থাকবে বরফে ঢাকা হিমালয়ের কোলে ?
একটা জুতো-মোজা পরা পা কত উথালপাতাল দেখল পাহাড়ে। ঝড় বয়, প্রবল ঠান্ডায় কাঁপতে থাকে চরাচর, কিন্তু পা-টি শুয়ে থাকে একা। একশো বছর ধরে।
একশো বছরের নিঃসঙ্গতা নিয়ে হয়তো অন্য কাহিনি লিখবে কেউ। হয়তো কোনও নতুন অভিযাত্রী বলবে, 'কেন যাই ? বিকজ ইট ইজ দেয়ার।'
হিমালয় তো থাকবেই, যেমন আছেন ম্যালোরি-আরভিন।
(সূত্র: সংগ্রহীত)
Post a Comment